আজ জুলাই মাসের ১ তারিখ। মাসটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক, যা গত জুলাইয়ের আগেও ছিল না। কারণ, জুলাইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গণ-অভ্যুত্থান, বিপ্লব। যে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পতন ঘটে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের। গত বছরের আজকের এই দিনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে এক উত্তপ্ত জুলাইয়ের গল্প। তবে জুলাই-২০২৫ বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার কাছে স্বাধীন, নতুন বাংলাদেশের নাম।
এদিন শিক্ষার্থীদের ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’ রূপ নেয়। এদিন চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, শেষমেশ তা গড়ায় সরকার পতনের আন্দোলনে, যার চূড়ান্ত প্রকাশ জুলাই গণঅভ্যুত্থান। ৩৬ দিনের সেই আন্দোলনে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। শুরুতে এই আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পরে তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
২০২৪ সালের ১ জুলাই সোমবার। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদ এবং কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে লাগাতার আন্দোলনের সূচনা করেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলে উত্তাল ক্যাম্পাস। ৩ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা। তবে সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রতি দিনের মতো বিএনপিকে নিয়ে আওয়ামী লীগ পড়েছিলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণ থেকে একটি মিছিল বের করে, যা রাজু ভাস্কর্যে শেষ হয়। সমাবেশ থেকে নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন, আগামী ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও পরীক্ষার বর্জন চলবে। তিনি তিন দিনের কর্মসূচিও ঘোষণা করেন ২ জুলাই দেশব্যাপী মহাসড়কে মিছিল, ৩ ও ৪ জুলাই রাজধানীর রাজু ভাস্কর্যে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সমাবেশ।
কোটা বাতিল করে বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশ শিক্ষার্থী। দুপুরে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়ে কলাভবন, মল চত্বর, ভিসি চত্বর ও টিএসসি হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সমাবেশে মিলিত হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘সংবিধানের/মুক্তিযুদ্ধের মূলকথা, সুযোগের সমতা’, ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে’, ‘১৮’র হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্রসমাজ জেগেছে’, ‘কোটা প্রথা বাতিল চাই বাতিল চাই’, ‘কোটা প্রথার বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ ইত্যাদি স্নোগান দিতে থাকেন।
দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতা থাকা দল আওয়ামী লীগ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। দলের সভাপতি সেদিন ভারতে পালিয়ে যান। তার দলের নেতাকর্মীরা আত্মাগোপনে চলে যান। আওয়ামী লীগ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হলেও সেই আন্দোলনের বীজ রোপন করা হয় ১ জুলাই। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ ৫৬ শতাংশ কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদ এবং কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে লাগাতার আন্দোলনের সূচনা করেছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেদিন মানববন্ধন, সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলে উত্তাল ছিল ক্যাম্পাস।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বছরপূর্তি উপলক্ষ্যে ৩৬ দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্র্বতী সরকার। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে জুলাই শহীদদের স্মরণ, পোস্টারিং, ডকুমেন্টারি প্রদর্শন, গ্রাফিতি, সব জেলায় জুলাই স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন, আলোচনা অনুষ্ঠান প্রভৃতি। ৫ আগস্ট মানিক মিয়া অ্যাভিনউ অভিমুখে বিজয় মিছিলসহ আরও কিছু আয়োজনের মাধ্যমে কর্মসূচি শেষ হবে। ১ জুলাই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শহীদদের স্মরণে দোয়া ও প্রার্থনা, খুনিদের বিচার দাবিতে গণস্বাক্ষর শুরু ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাবৃত্তি চালু।
এছাড়াও শিক্ষার্থী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণে আজকের দিনটি স্মরণীয় হয়ে উঠছে নতুন এক প্রতিবাদ-সংগ্রামের ইতিহাস হিসেবে।